আবার একটা লম্বা গল্প লিখে ফেললাম।যদিও Golam Destegir ভাইয়ের বলদপ্রীতি দেখে আমার আমাদের এই পারিবারিক কাহিনীর কথা মনে পড়ে গেছে, গল্পটা কিন্তু উনার আবেগের সম্পূর্ণ বিপরীত মেরুকেন্দ্রিক! যাই হোক, কাহিনীটা নিচে বলছি…
আমি এই এতো বছর বয়স পর্যন্ত আমাদের বাড়িতে কোনো বলদ গরু কিনতে দেখি নাই। আমার বা আমার বাবার তো কেনা হয়-ই নাই, আমার চাচাফুপিদের বা আমাদের কোনো ভাড়াটিয়াদেরও কখনো কিনতে দেখি নাই। চাচা আর ভাড়াটিয়াদের কাউকে কাউকে ২-১বার বকনা কিনতে দেখসি, তবে তাও খুব রেয়ার, লিটারেলি ২-১বার-ই। তবে এই বাড়িতেই বলদ কিনে আনা নিয়ে একটা মজার স্টোরি আছে।
গল্পটা শোনা গল্প, আমার খুব নিকট একজন আত্মীয়ের মুখে। উনার আবার টুকটাক বানায় বানায় গল্প বলার অভ্যাস আছে তাই এই গল্পের কতটুকু সত্য কতটুকু উনার কল্পনা জানি না। তবে উনি আমাকে এই গল্পটা বলেন কারণ এই গল্পের কেন্দ্রীয় চরিত্র ছিলেন আমার আব্বাজান।
আমার বাপচাচারা ৯ ভাইবোন। আমার বাবাসহ দাদার ছয়জন ছেলে ছিলেন। তবে দাদার গরু সবসময় কিনে আনার দায়িত্ব ছিলো তার বড়ছেলে আমার বাবার উপর। শুধু বড় দেখেই না, আব্বু গরু ভালো কিনতে পারতেন এটা একটা বড় কারণ ছিল। আর আমার গরুপাগলামি যে আমি উত্তরাধিকার সূত্রে উনার কাছ থেকেই পাইসি তাতেও কোনো সন্দেহ নাই।
এখন মূল ঘটনায় আসি, স্বাধীনতার ২-১ বছর আগে-পরের কোনো এক কোরবানির ঈদের ঘটনা। আব্বু তখন গরু নিয়ে আসতো হয় গাবতলি থেকে নয় একবারে আমাদের দেশের বাড়ি মানিকগঞ্জ থেকে। সেখান থেকেই হাটতে হাটতে এই বাড়িতে গরু নিয়ে আসতেন। সাথে এসিস্ট্যান্ট কাম রাখাল হিসাবে থাকতেন দাদার ব্যবসার একজন খুবই বিশ্বস্ত কর্মচারী মকবুল চাচা এবং মাঝেসাঝে আমার মেজো চাচা। সেবার আমার মেজোচাচাও বায়না করে আব্বু আর মকবুল চাচার সাথে গেছিলেন গরু কিনতে।
তো, সেই বছর দেশের পরিস্থিতি বেশ ভাংগা-গড়ার মধ্যে দিয়ে যাচ্ছিলো। কোরবানি দেবার মতো মানুষের পরিমাণও ছিল কম। গরুর বাজার শুরু থেকেই ছিলো মন্দা। আব্বুরা সেবার গেছিলো গাবতলি হাটে। হাটে গিয়ে তারা দামদর করতে করতে হঠাৎ একটা বিশাল বলদ পেয়ে যায় অবিশ্বাস্য কম দামে। সাদা রংগের ইন্ডিয়ান বলদ। যার কাছে শুনসি তার ভাষ্যমতে, ওটা ছিল হাটের সবচেয়ে বড় গরু। আমার বাপচাচা ২জন সস্তায় পেয়ে মহানন্দে সেই বলদ কিনে নেন মাত্র আড়াইশো টাকায়!!
(ভাই ওই আমলের আড়াইশো মানে এই আমলে কতো আমি জানি না। আমার কথা শুনে আমাকে নিয়ে হাসাহাসি কইরেন না, আমি নিজে গল্পটা শুনসি আরেকজনের কাছে। ছোটবেলায় যখন এই গল্প শুনসিলাম তখন আমিও ধরে নিসি গল্প বলতে গিয়ে উনার কোথাও ভুল হচ্ছে, আড়াই হাজারকে ভুলে আড়াইশো বলে ফেলছে।)
এদিকে গরু কিনে ৩ কীর্তিমান তো খুশিতে বাগবাগ। হাটের সবচেয়ে বড় গরু কিনে ফেলসে এবার তারা। উঠতি বয়স, সদ্য তরুণ। এই আজদাহা সাইজের গরু নিয়ে এসে এলাকায় ঢুকলে কি একটা আলোড়ন উঠবে, তার উপর দাদা কত্তো খুশি হবেন ভেবে ৩জনই আপ্লুত। খুশিতে তাক ডুমাডুম করতে করতে বলদ নিয়ে ৩জন বাড়ির সামনে এসে উপস্থিত।
সেই ভোরে গাবতলি গিয়ে গরু কিনে হাটতে হাটতে বাড়িতে আসতে আসতে ততক্ষণে অবশ্য অনেক রাত। ওই আমলের হিসেবে প্রায় মাঝরাত। তাও, তাদের হাল্লাচিল্লা করে আসার শব্দ শুনে এলাকার লোকজন মানে প্রতিবেশীরাও বের হয়ে আসছে। মীর সাহেবের গরু আসছে!
গরু নিয়ে বাড়ির গেট পর্যন্ত এসে উনারা দেখে দাদা দোতালার টানা বারান্দায় সটান সোজা হয়ে দাড়ায় আছেন। রাগে গনগন করতেসেন! উপর থেকে হুংকার দিয়ে বললেন, “এটা কি এনেছিস?”
আমার দাদা মানুষ হিসাবে খুবই ভালো বলে বিখ্যাত ছিলেন। কিন্তু উনার মেজাজ ছিল কিংবদন্তী লেভেলের। এককালে কোলকাতায় জেলের জেইলর ছিলেন, পরে ব্যবসায় মনোযোগ দিয়ে ঢাকায় সেটেল করেন। লিটারেলি “আংরেজ কি জামানে কি জেইলর” টাইপের মেজাজ ছিল উনার। সেই উনাকে ওইরকম বিভীষণ মূর্তিতে দাড়ায় থাকতে দেখে আব্বু আর চাচ্চুর জানপাখি নগদে উড়ে গেল। দাদার হুংকার শুনে আব্বু বা চাচ্চুর কোনো একজন কোনমতে বলসেন, “আব্বা এবার খুব সস্তায় এই গরুটা কিনেছি। হাটের সবচেয়ে বড় গরু। দরজাটা একটু খুলে দিতে বলেন….”
জবাবে দাদা নাকি বলসিলেন, “তোরা দুই বলদ এক্ষুনি এই বলদ নিয়ে দূর হয়ে যা। যেখান থেকে পারিস আমার কোরবানির ষাঁড় কিনে আনবি, এছাড়া এই বাড়িতে ঢুকবি না।”
কথা ওখানেই শেষ। ওভার এন্ড আউট!
আব্বুরা হাড়ে হাড়ে জানতেন দাদা কি জিনিস। তারা ওই রাত্রেই তখনই গেটের বাইরে থেকেই আবারও ওই গরু নিয়ে গাবতলিতে ফেরত যান। দুই ভাই মিলে সারারাত দাড়ায় থেকে সেই বলদ গরু বেচেন। তারপর সেই টাকায় দাদার কোরবানির ষাঁড় কিনে পরদিন ফেরত আসেন।
এইবার বাড়িতে ঢুকার অনুমতি মিলে।
সেই শেষ! আমার মনে হয় না এরপর আর কোনদিন আমার বাপ বা কোন চাচা আবার বলদ কেনার কথা কল্পনাও করসেন। অন্তত আমি আজ পর্যন্ত তাদের কিনতে দেখি নাই। 😐