পিছুটান – Golam Destegir

পিছুটান – Golam Destegir

।। পি ছু টা ন।। 

গুগলে সার্চ করলে দেখা যায় বাংলা হলো পৃথিবীর সবচেয়ে অন্যতম মিষ্টি ভাষা। আর সেই মিষ্টি ভাষার একটা খুব মিষ্টি শব্দ হলো “পিছুটান” যার অর্থ হলো জীবনের তাগিদে সামনে এগিয়ে যাওয়ার জন্য পেছনে ফেলে আসা পুরানো অনেক কিছুর সাথে এক অদৃশ্য যোগসূত্র। যা মনের অজান্তেই আমাদেরকে বারবার সেখানে ফিরিয়ে নিয়ে যায়। আর কোরবানি ঈদের গরু আর গরুর হাট নিয়ে পাগলামি ঠিক তেমনি এক পিছুটান আমার জীবনের। 

যেখানে আমি রেখে এসেছি আমার কৈশোর পেরিয়ে যৌবনের ৪০ বছরের গরু পাগলামির গল্পগাঁথা। তাই মাঝে মাঝে ভাবি আমরা যারা জীবনে ভালো কিছু করার আশায় সেইসব ছোট্ট মায়ার পাড়া-মহল্লা থেকে এইসব বড় বড় শহরে চলে এসেছি। তাদেরকে কোরবানির সময়টায় একটু চড়া দামেই সেই পিছুটানের মূল্য পরিশোধ করতে হয়।

২০১৭ তে কোরবানি ঈদ করে যখন আমি দেশ ছেড়ে চলে আসি তখনও ছেলেটা আমার অনেক ছোট। এছাড়া বাসায় গরু কিনে কোরবানি সম্পন্ন করার মতো লোকের অভাব। তার উপর ২০১৯ এ গেন্ডারিয়া থেকে পুরো পরিবার ধানমণ্ডিতে স্থানান্তর হওয়ায় সেই সংকট আরও প্রকট হয়ে উঠে। তারপরে করোনা। সব মিলিয়ে গরু কোরবানিটা মাঝের কয়েকটা বছর একেবারেই বন্ধ ছিল। 

শুধু কোরবানি ওয়াজিব হওয়ায় আদায়ের জন্য লোক মারফত একটা খাসি কিনে কোরবানি দেওয়া হতো। আর এইভাবে ২০২২ এ এপার্টমেন্টে বাকি সবার কোরবানির পশু দেখে খাসি কেনার অবদার নিয়ে ছেলের গোপন ফোন কল আসে আমার কাছে।

ছেলের অবদারটা কেমন যেন একটা টনিকের মতো কাজ করে আমার ভেতরে। কেউ যেন নিজের ভেতরের ঘুমিয়ে থাকা কোরবানি নিয়ে পাগলামির করা সেই দানবটাকে ঘুম ভাঙ্গানোর দুঃসাহস করে বসলো। ঠিক যেমন রাফসানের ৬ বছরের তার লেখা কোরবানির গল্পটা আজকের এই লেখার পেছনে ভুম ভাঙ্গানির কাজ করেছে। লেখাটা পড়ে ফিল হলো আসলেইতো অনেকদিন হয়ে গেছে কিছু লিখি না গ্রুপে। অনেকদিন হয়ে গেলো গল্প করি না সবার সাথে। 

সত্যি বলতে ব্যস্ততা, বাস্তবতা আর প্রবাসের হ্যাক্টিক জীবন আপনাকে আপনার থেকে কেড়ে নিবে। আপনি নিশ্চিত ভুলে যাবেন নিজেকে। আপনি চাইলেও আপনার আপন হয়ে থাকতে পারবেন না। তাই আর লেখা হয় না। যাক সেইসব কথা। 

ছেলের সেই এক আবদারের গোপন ফিসফিসিয়ে ফোন কল 

-বাবা, তুমি না আমাকে ছাগল কিনে দিতে চাও কোরবানির জন্য। তাহলে এইবার আমাকে একটা ছাগল কিনে দাও।

ব্যাস… দানবের ঘুম ভেঙ্গে গেলো। যেন এই এক ফোন কলের জন্যই এতোদিন অপেক্ষায় ছিল। এখানে বসেই ঘন্টা খানের কম সময়ের মধ্যেই এক জোড়া খাসি কিনে ফেলি আমাদের প্রিয় এডমিন বাবাজি সৈকতের পরামর্শে। তার পাশাপাশি প্রতিবছর লোক মারফত কোরবানির জন্য যে খাসিটা কেনা হয় সেটাও বাসায় আনা হলো। কারণ ততক্ষণে তাকে খাসি কেনার টাকা দেওয়া হয়ে গিয়েছিল। 

সেই বছর ছেলে মহা ধুমধামে তিনটা খাসি কোরবানি দিলো। আর আমাদের মধ্যে এক গোপন আতাত হয়ে গেলো যে, এখন থেকে আমরা গরু কোরবানি দিবো। তবে আমি শর্ত জুড়ে দিলাম ছেলেকে। কোরবানির গরুর দেখভালের দ্বায়িত্ব তাকে নিতে হবে। আসলে এই শর্তের মুল উদ্দেশ্য ছিল ছেলের ভেতর কোরবানির পাগলামিটা পাকাপোক্ত করা। আমাদের রক্তের ধারাটাকে তার ভেতর ঢুকিয়ে দেওয়া। 

২০২২ এর কোরবানির পরপরেই আমি ২০২৩ এর জন্য গরু খোজা শুরু করে দেই। এবং তারই পরিপ্রেক্ষিতে আগস্ট’২২ -এ আমি আমার ২০২৩ এর কোরবানির গরু বোরাকের খোজ পাই। এবং বোরাককে খুজে বের করে কোরবানি পর্যন্ত সফরটা গ্রুপের সবারই জানা তাই আর সেইসব বিশদ ভাবে লিখলাম না। তবে বোরাক বাসায় আসার পর থেকে জবাইয়ের আগ পর্যন্ত আমার ভেতর যে অনুভূতিটা কাজ করছিল সেটা লিখে বর্ণনা করা সম্ভব নয়। বিশেষ করে ঠিক জবাইয়ের আগে এতো কষ্ট পেয়েছিলাম যা আমি আগে কখনই অনুভূব করি নাই। 

সেই মুহুর্তে আমার ছেলের মনের অবস্থাও খুব বাজে ছিল। যদিও বোরাক বাসায় আসার পর থেকে আমরা বাপ ছেলে অলমোস্ট পুরো সময়টাই ভিডিও কলে কাটিয়েছিলাম। ছেলে আমাকে বোরাকের প্রতিটা মুহুর্তকে লাইভ দেখাতো কিন্তু জবাইয়ের আগে আমরা কেউ ভিডিও কলে আসতে পারছিলাম না। কারণ ছেলে এবং আমি দুজনই খুব কষ্টে নিজেদের কান্না লুকিয়ে রেখেছিলাম। 

সত্যি বলতে জীবনে আল্লাহ্ এতো গরু কোরবানি দেওয়ার তৌফিক দিয়েছে কিন্তু বোরাককে কোরবানি দেওয়ার মতো এতো কষ্ট আমি আর কোন গরুর বেলায় অনুভব করি নাই। বোরাককে কোরবানি দেওয়ার পরে মাথায় এমনও ভাবনা চলে এসেছিল যে, আর কোনদিন গরুই কিনবো না। 

সেই হিসেবে বোরাক আমার মনের সবচেয়ে ভালোবাসার গরু হয়ে থাকবে সারাজীবন। আর এর জন্যই বোরাক আমার জীবনের সবচেয়ে চড়ামূল্যের পিছুটান।

Comments

No comments yet. Why don’t you start the discussion?

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *