স্মৃতিচারণা – Mir N. Hasan

আজকের লেখাটা আমি Arif Rafsan ভাইকে ডেডিকেট করছি। এটা কোনো একদিনের ছোট গল্প না। এটা অনেকটা আমার স্মৃতিচারণা, সাথে আল্লাহর কাছে একটা প্রার্থনা। ও হ্যা, এর সাথে আমার বাবার ২০১৪ সালের গরুর ছবি দিয়ে দিচ্ছি।

আমি একজন এমবিভার্ট মানুষ। তবে ছোটবেলায় পিচ্চি হলেও ছিলাম বেশ চাপা ধরনের মানুষ। খুব একটা এক্সপ্রেসিভ না, কোনো আবেগ-অনুভূতিই ঠিকমতো প্রকাশ করতে পারতাম না। তাই ভীতুও কেউ ভাবতো না। তবে কোরবানির ঈদের সময় বাড়িভরা মানুষের সবার একসাথে মনে পড়ে যাইতো এই পিচ্চি একটা বিরাট ভীতুর ডিম। ভীতু মানে ভয়াবহ ভীতু। তখন আমি প্রকাশ্যে ২টা জিনিসকেই মাত্র ভয় পাইতাম, আমার টিচার আর কোরবানির গরু। যদিও ছোটবেলায় খুব ভালো ছাত্র ছিলাম দেখে টিচারদের ভয় পাওয়ার ওই ব্যাপারটা আমি, আমার মা আর বাসার টিচার ছাড়া কেউ টের পান নাই কিন্তু গরুকে ভয় পাওয়ার মাত্রাটা এতো বেশী ছিল যে গুষ্টিসুদ্ধা মানুষ এই ব্যাপারে ভালোভাবে ওয়াকিবহাল ছিল। আমার চেয়েও আমার ছোট কাজিন ভাই সাহস বেশী রাখতো, আমাকে সাহস দেয়ার চেষ্টা করতো। লাভ হয় নাই।
কিন্তু আমি গরু যেই পরিমাণ ভয় পাইতাম, আকর্ষণ বোধ করতাম তার তিন গুণ বেশী।

আমাকে যারা আগে থেকে জানেন, আমার বাড়িতে বাঁধা গরু দেখেছেন তারা সবাই জানেন আমার বাড়ির সামনে একটু খোলা আর পাকা আংগিনা বা উঠানের মতো আছে। এক পাশে আছে গ্যারেজ। কোরবানির গরু আমরা এই উঠানে বেঁধে রাখি। আগে গ্যারেজেও রাখা হতো, এখন হয় না, উঠানেই সবগুলা বাঁধা থাকে। বাড়ির সবাই যার যার বারান্দায় দাড়ায়ে নিজের গরু দেখতে পান। তবে বারান্দায় দাড়ায় দেখতে হলে সবচেয়ে ভালো করে দেখা যায় দোতলার বারান্দা থেকে।
আজকে স্বীকার করতে লজ্জা নেই, ছোটবেলায় আমি গরু দেখতাম ওই দোতলার বারান্দায় দাড়ায় থেকে।
ভয়ের চোটে নিচে নামতে পারতাম না। সব কাজিনরা নিচে নেমে গরু দেখতো, ক্রিকেট খেলতো আর আমি বারান্দায় ঠায় দাড়ায়ে বা মেঝেতে থম মেরে বসে থেকে গরু দেখতাম। দেখতাম আর দেখতাম। দেখতেই থাকতাম, নড়তাম না। কারো সাধ্য ছিল না আমাকে নেয়ার। খাবারও ওখানে খেতাম। বারান্দার দুই পাশে আমার দুই চাচার ফ্ল্যাট। চাচীরা টেনেও তাদের ফ্ল্যাটে নিতে পারতেন না, আমি ওখানেই বসে থাকতাম।

ক্লাস টু, থ্রি পর্যন্ত আমার এভাবেই কাটে। ফোর, ফাইভে উঠে সাহসের গুল্লি খেয়ে নিচে গরু বাঁধা থাকা অবস্থায় নিচে নামা, খেলাধুলা শুরু করি। এটা তখন প্রেস্টিজ ইস্যু। স্কুলে তখন একা যাওয়া-আসা করি। ক্লাস ফোর থেকে স্কুল পালাই। ইতিমধ্যে বাসা ছেড়েও পালাইসি একবার। আর গরু থাকলে নিচে নামতে পারি না, এটা কেমন কথা!

তখনও কিন্তু আমার হাটে গিয়ে গরু কেনার মতো সাহস বুকে হয় নাই। হাটে যাওয়া দূরে থাক, কোরবানির সময় রাস্তায় হাটতাম না পাছে যারা গরু হাটায় নিয়ে যাচ্ছে তাদের, মানে খোলা অবস্থায় থাকা কোন গরুর মুখোমুখি পরে যাই!

এর মধ্যেও হাটে গেছিলাম একবার, ক্লাস টু-থ্রি তে, বাবা চাচা কাজিনদের সাথে। কমলাপুর হাট। কাজিনরা সাহস দিয়ে নিয়ে গেছিলো। সেই সাহস যেতে যেতে পথেই শেষ, হাটের গেট পর্যন্ত গিয়ে প্রায় গগনে চাঁদ দেখে ফেললুম! কেউ আর টেনেও ভিতরে নিতে পারে না। আব্বু প্রচুর কায়দা-কসরত করলো, ধমকধামক দিল। লাভ হইলো না। শেষে আমার জায়গা হলো হাসিল ঘরের টংগে। ওইখানে বসে থেকেও ভয়ে ছিপি খুলে যায় যায় অবস্থা। ওখানে আমাকে বসায় রেখে বাকিরা গরু কিনে আনেন। আব্বু বলে দিসিলো আর কোনোদিন আমাকে হাটে নিবে না।

এর থেকে বেশিদিন পরের কথা না, হয়তো ২-১বছর পর, ক্লাস ফাইভ-সিক্সে, এই প্রচন্ড ভীতু পিচ্চিরও হাটে গিয়ে আব্বুর গরু কিনতে হইসিলো। তাও গ্রামের জমজমাট ঈদের হাটে গিয়ে।
ওইসময় থেকেই দিন বদলে যায়।

আমাদের বাবা-চাচারা তখন সবাই মিলে কোরবানি দিতেন। কখনো কখনো আয়-রোজগার বেশী থাকলে দুই-একজন একা একা আলাদাও দিতেন, আবার অনেকসময় ২-১জন হয়তো কোরবানি দিতেনই না। আব্বু সবসময় ভাইদের সাথে দিতে ভালোবাসতেন। হাতে টাকা বেশী থাকলেও উনি আলাদা একা দিতেন না। কম থাকলেও কোরবানি দেয়া বাদ দিতেন না, কোনভাবে ম্যানেজ করে নিতেন। আমি যখন ফাইভ বা সিক্সে পড়ি এরকম সময়ে কোরবানির শরীকদের মধ্যে একজন আব্বুর সাথে কোনো পার্সোনাল কারণ নিয়ে ঝগড়া করে বসেন। যার সাথে ঝগড়া হয় উনি খুব তেড়িয়া টাইপের মানুষ আর এদিকে আব্বু আবার একটু আলাভোলা টাইপের। আব্বু ওই ঝগড়া নিয়ে মাথা ঘামাননি। দশটা পাতিল এক জায়গায় থাকলে ঠোকাঠুকি হবেই, তাতে কি। ওইদিকে ওই শরীক বাকিদের কিভাবে কিভাবে যেন ভুংভাং বুঝায়ে কনভিন্স করে ফেলসেন যেন এবার সবাই আলাদা আলাদাভাবে কোরবানি দেয় অথবা এবার আব্বু একা কোরবানি দিবেন, তারসাথে যেন শরীকানা নিয়ে আলাপ না করা হয় এরকম কিছু একটা। এদিকে আমাদের পরিবার কিছুই জানতো না। আমাদের শরীকানা থেকে আমাদের অজান্তেই বাদ দিয়ে দেয়া হয়।

ওই বছর আব্বুর ফিনানশিয়াল অবস্থা খুব একটা ভালো ছিলো না। বলতে গেলে টানাটানিই ছিল। কোরবানি ওয়াজিব ছিল, তবে হাতে পর্যাপ্ত টাকা ছিল না। ঈদের যখন আর মাত্র ৫-৬ দিন বাকি, গরুর বাজেট ঠিক হবে, তখন আব্বুকে জানানো হলো আব্বুকে তো এবার শরীক হিসাবে রাখা হয় নাই। পার্টনার ঠিক হয়ে গেছে। ২জন আলাদা কোরবানি দিবেন। আর বাড়ির সবার শরীকানার গরুতে নাকি এবার বাইরের লোক নেয়া হয়েছে, আব্বুকে বাদ দিয়ে।

এরকম কষ্ট আব্বু জীবনে পান নাই।

চোখে পানি এসে গেছিলো ভদ্রলোকের। হাতে টাকাও নাই যে একা দিবেন। কি করবেন বুঝে উঠতে পারছিলেন না। আমারও কষ্টে বুক ফেটে যাচ্ছিল। এক আব্বুকে এরকম অবস্থায় দেখে, দুই আমরা কোরবানি দিতে পারবো না, এই কথা জেনে। আম্মু সাহস দেন আব্বুকে। আব্বু যেভাবেই হোক একাই দিবেন ঠিক করেন। উনার কাছে ছিল ছয় হাজার টাকা আর আম্মুর অনেকদিনের জমানো ছিল হাজার তিনেক টাকা। এরমধ্যেই হাসিল, কসাইসহ সব খরচ সমাধা করতে হবে। তাতে আব্বুর আপত্তি নাই। উনি উনার ওয়াজিব আদায় করতে পারবেন জেনেই খুশি। কোরবানি দিতে পারবেন এই আনন্দে উনার মধ্যে নতুন উদ্যম এসে গেলো। প্ল্যান করলেন বাজেট কম দেখে মানিকগঞ্জ চলে যাবেন গরু আনতে, ঢাকার হাটের থেকে ভালো হবে। আর যেই দুইজন আলাদা দিচ্ছিলেন তাদের সাথে কথা বলে ঠিক করলেন ঢাকা থেকে সকালে পিকআপ নিয়ে গিয়ে গরু কিনে ওইদিনই চলে আসবেন। পিকআপ ভাড়াও হয়ে গেল।

আমি মানুষটা তখন ভীতু হলেও অন্তত এটুকু বুঝতে পারসিলাম, আমার বাপটা আজকে একা। যাদের সাথে আব্বু হাটে যায় তারাও তো আজকে আলাদা, আব্বু একা একাই অনেকদূরে যাবেন আমাদের গরু আনতে। যদিও সাথে অন্য চাচারা যাচ্ছেন তাদের গরু আনতে কিন্তু আব্বুর গরু আব্বুর একাই কিনতে হবে।

আর একটা জিনিস আমার মনে হইলো। ছোট হোক, বড় হোক এবার আব্বুর একা একটা আলাদা গরু হবে। হয়তো এখন থেকে প্রতিবারই তাই হবে – আব্বু আম্মুর কথায় এরকমই মনে হচ্ছিল। দুইজনই অনেক কষ্ট পাইসিলেন। ঠিক করসিলেন এ-ব্যাপারে আর কখনো অন্য কোন মানুষের মুখাপেক্ষী থাকবেন না। আমাদের নিজেদের গরু নিজেদের কিনতে হবে, আব্বুর একারই কিনতে হবে।

ঠিক করে ফেললাম যেভাবেই হোক, যত ভয়ই লাগুক আমি আব্বুর সাথে যাবো। আব্বু একা যাবে না। আব্বুকে বলতেই আব্বু খুবই খুশি হয়ে রাজি হয়ে গেলেন। ভুলেই গেলেন আমি ভীতু দেখে আমাকে উনি আর কখনো নিবেন না বলে দিসিলেন।
যাইহোক, যাওয়ার দিন পিকআপে উঠতে গিয়ে দেখি যারা শরীকানায় গরু দিবেন তারাও এখন আমাদের সাথে যেতে চাচ্ছেন। নেয়া হলো তাদেরকেও।

এই প্রথম আমি গ্রামের হাটে যাই। শুধু গ্রামের হাটে কেন, এই প্রথম আমি কোন হাটের ভিতর যাই। এই প্রথম আমাদের বাপ-ব্যাটার একসাথে ঘুরে ঘুরে গরু কেনা হয়। এই প্রথম খোলা পিকাপে বসে যাওয়া আসা হয় আমার। কিসের ভয়, কিসের কি! যদিও গাড়ি ছিল তবু আমি যাওয়ার সময় পিকাপের পিছনে বসে গেছি, আসার সময় গরু পিছনে রেখে বাপ-ব্যাটা পিকাপের ড্রাইভারের পাশের সিটে বসে আসছি।

গরুর দাম ছিল সাড়ে সাত হাজার টাকা। বাকি দেড় হাজার টাকায় পিকআপ ভাড়ার শেয়ার, কসাই খরচ, গরু পালার খরচ, বখশিশ ইত্যাদি সব খরচ মেটানো হয়। দাড়োয়ানের সাহায্য নিয়ে আমি নিজেই গরু পালি, খাবার দেই, সাথেই থাকতাম সারাক্ষণ। ওই বছর বাড়িতে ওই গরুটাই সবচেয়ে ভালো হয় আলহামদুলিল্লাহ।

পরের বছর পার্টনার না পেয়ে আব্বুকে আবার শরীকানায় সামিল হবার জন্য অনুরোধ করা হয়। আব্বু আর রাজি হন নাই। যদিও উনি উনাদের মানা করে দেন, কিন্তু বাসায় এসে খুব মন খারাপ করে ছিলেন। মনে মনে তিনি একসাথেই কোরবানি দিতে চাচ্ছিলেন, কিন্তু অপমান মেনে নিয়ে বারবার ইউজড হতে চাননি। আল্লাহর কি আজব খেল, যার কৌশলে আব্বু শরীকানা থেকে বাদ পরে যান সেই উনি গত এতগুলো বছরে ২-৩বারের বেশী কোরবানি দিতে পারেননি। যদিও উনিও গরুপাগল মানুষ। অন্যের গরু কিনে দেন, নিজে শরীক হতে পারেন না। তবে গত দুইবছর দিতে পেরেছেন আলহামদুলিল্লাহ। আমি চাই সবসময় পারুন, ভালোভাবে পারুন। উনি দিতে না পারাতে আব্বু-আম্মু উনাকে আলাদাভাবে একটা বড় অংশ পাঠিয়ে দিতেন। আজও দেয়া হয় আলহামদুলিল্লাহ।

যাই হোক, সেই আমাদের বাপ-ব্যাটার পার্টনারশিপের শুরু। তখন থেকে আমরা বাপ-ব্যাটা একসাথে হাটে যেতাম আসতাম, গরু কিনতাম। মানিকগঞ্জ থেকে বেশ কয়েকবার কিনি, এরপর ঢাকা থেকেই কেনা হতো। টাকার কষ্ট আল্লাহ আর দেন নি। প্রতিবছর আগের বছর থেকে বেশি সাহায্য করেছেন। বার্গেইনিং এর দায়িত্ব ছিল আব্বুর, কেনার পর আনার-পালার দায়িত্ব ছিল আমার। কসাই দিয়ে গরু কাটানোর দায়িত্ব আব্বুর, সাথে যোগালির কাজ করার দায়িত্ব আমার। ১০১টা বাড়ির মাংস দিয়ে আসার দায়িত্ব ছিল আব্বুর, ২-১টা আমার।

এভাবেই চলছিলো।

একসময় আব্বুকে ছাড়াই হাটে ঘুরতে যেতে শিখে যাই। স্কুল পালায় হাটে কত ঘুরসি হিসাব নাই। সবচেয়ে বেশি যেতাম কমলাপুর। এছাড়া মেরুল-বাড্ডা, নয়াবাজার(১-২বার), গাবতলি তারপর শাহজাহানপুরেও যাওয়া শুরু হয়। স্কুলের বদলে একসময় কলেজ পালানো, তারপর ভার্সিটি থেকে বাংক মারা শুরু হয়। সবসময় টার্গেট একটাই থাকতো, আব্বুর জন্য বাজেটের ভিতর সেরা গরুটা কিনতে হবে। দেশী ষাঁড়, ছোটখাটো, দুই দাঁত (৪ দাঁতও চলে, তবে ২দাঁত হলে বেশি ভালো হয়)।

এক কোরবানির ঈদের আগে আগে কি হইলো কে জানে, আমার হাতে একটা খাম ধরায় দিয়ে আমার পার্টনার গরু কোরবানির পুরো ভার আমার হাতে দিয়ে কয়েকদিনের জন্য আল্লাহর ঘরের মেহমান হতে (হজ্ব) চলে গেল। সেই যে গেল, এতগুলা বছর হয়ে গেল আর ফেরত আসলো না, আর আসবেও না। শুনসি আল্লাহর ঘরের মেহমান ছিলেন, আল্লাহ নিজের কাছেই রেখে দিসেন। আমি আর দেখতে পাব না। এখন থেকে উনার কোরবানির ব্যবস্থা আমার একারই করতে হবে।

করে যাচ্ছি। এখন আমি নিজের ব্যবসা থেকে নিজেই পালায় যাই। পালায় গিয়ে এখনো হাটে আব্বুর জন্য আমার স্বল্প ক্ষমতার মধ্যে একটা দেশী ষাঁড় গরু খুঁজি, ছোটখাটো, দুই দাঁত।

জানি না এই বছর পারব কিনা।

ইয়া মালিক, আজ এতবছর ধরে আমরা বাপ-ব্যাটা হারি নাই, নিরাশ হই নাই, তোমার সাহায্য থেকে বঞ্চিত হই নাই। এইবছরও আমাদের থেকে মুখ ফিরায় নিও না। এই গ্রুপটায় এতগুলা মানুষ, আমাদের-আমাদের বাবামায়ের-আমাদের পরিবারের যার কোনো নেক আমল তুমি কবুল করেছ, সেই নেক আমলের ওসিলায় তুমি এইবারও আমাদের সবার নসীবে কোরবানির তৌফিক দিও, আমাদের হায়াত দিও, সুস্বাস্থ্য দিও। পুরো পৃথিবীটাকে আবার সুস্থ করে দিও।

আমি আব্বুর গরু কিনতে যেতে চাই। দায়িত্ব দিয়ে গেছেন তো।

Comments

No comments yet. Why don’t you start the discussion?

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *